নেই হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ! মুর্শিদাবাদের দেবী কিরীটেশ্বরী ‘সবার’
নিউজ ডেস্ক: মুর্শিবাদের নবগ্রামের দেবী কিরীটেশ্বরী কিন্তু জাতপাত, ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে সবার আরাধ্য। এই মন্দিরে হিন্দু এবং মুসলমান মিলেমিশে পুজোর সব দেখাশোনা করেন।
কথিত আছে, সিদ্ধতান্ত্রিক রাজা রামকৃষ্ণ রায় এই মন্দিরের পঞ্চমুণ্ডির আসনে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
বলা হয়, এই মন্দিরের সাথে নাকি বাংলার ইতিহাসের বহু সুখ-দুঃখের ঘটনা জড়িত রয়েছে ।
দেবী কিরীটেশ্বরী মন্দিরের সেবাইত নেপাল বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, ‘দেশে যখন ধর্মীয় মেরুকরণের উদ্বেগ, তখন এখানকার মুকুন্দবাগ গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা প্রয়াত আবদুল হাকিম মণ্ডলের সংকল্পকে বাস্তবায়িত করতে তাঁর পুত্র জমি দান করেন মন্দিরকে। তবে ইতিহাস বলে বাংলার সংস্কৃতিতে এই ধরনের ঘটনা স্বাভাবিক।’
কোথায় অবস্থিত এই মন্দির ?
মুর্শিদাবাদের দহপাড়া রেল স্টেশন থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই দেবী কিরীটেশ্বরীর মন্দির। প্রচলিত আছে, এখানে সতীর মুকুট বা কিরীট এসে পড়েছিল, সেই কারণেই দেবীকে ‘মুকুটেশ্বরী’ বলেও ডাকা হয়।
১৪০৫ সালে দেবীর প্রাচীন মন্দিরটি ভেঙে পড়ে। এরপর ১৯ শতকে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ রায়ের নির্দেশে নতুন মন্দির নির্মাণকার্য সম্পন্ন হয়।
কালীপুজোর দিন, ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত এই দেবস্থানে হাজার হাজার শাক্তবিশ্বাসী ভক্তদের সমাগম হয়।
এই কিরীটেশ্বরী মন্দিরের দেবীর কোনও নিয়তাকার মূর্তি নেই বা কোনও ছবিও নেই, এখানে আরাধ্যা দেবী শিলাস্বরূপা।
মন্দিরের পূজারী জানান, যে একটি লাল রঙের শিলাকেই মাতৃজ্ঞানে পূজা করা হয় এই মন্দিরে। এবং এই বিশেষ শিলাটি একটি আবরণে আচ্ছাদিত রাখা হয়।
প্রত্যেক বছর দুর্গা পুজোর অষ্টমীর দিন এই আবরণটি পরিবর্তন করা হয়। জানা গেছে যেই মুকুটের মহিমাতে এই শক্তিপীঠের উত্পত্তি, সেই মুকুটটি সযত্নে, মন্দিরের কাছে অবস্থিত রানি ভবানীর গুপ্ত মঠে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে।
এই মন্দিরে গেলে দেখতে পাবেন, দেবীর প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও এই নতুন তৈরী হওয়া মন্দিরের সামনেই অবস্থান করছে।
ইতিহাসে উল্লেখ্য আছে, মুঘল সম্রাট আকবরের থেকে লালগোলার রাজা ভগবান রায় এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পান। এই ভগবান রায়েরই বংশধর ছিলেন দর্পনারায়ণ।
এই মন্দিরে মায়ের বিশেষ পুজো হয় দুর্গা পুজো এবং কালী পুজোর সময়। এ ছাড়াও মাঘ মাসের রটন্তী অমাবস্যায় এইখানে বিশেষ পুজো হয় দেবীর। জানা গেছে, সেই রাজা দর্পনারায়ণের আমল থেকে পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবারে একটি বিশেষ মেলা বসে এই মন্দিরের কাছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
তকথিত আছে, পলাশীর যুদ্ধের পর যখন বাঙলার ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র মিরজাফর, নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে তাঁর সঙ্গী রাজা রাজবল্লভকে নির্মম ভাবে হত্যা করেন। সেই দিন এই মন্দিরের একটি শিবলিঙ্গ নাকি নিজে থেকেই ফেটে গিয়েছিল।
মিরজাফর শেষ বয়সে কঠিন কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হন। সেই সময় অনুশোচনা তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ওই সময় তিনি দেবীর চরণামৃত পান করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল ওটা পান করলেই তিনি কুষ্ঠ রোগমুক্ত হবেন।
দেবীর চরণামৃত যখন তাঁর কাছে আনা হয়, তখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত। ওই চরণামৃত মুখে দেওয়ার পরই নাকি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন মিরজাফর।
এই সব কাহিনি আদৌ সত্যি না মিথ্যা তাঁর কোনো প্রমাণ নেই। তবে এই কথাটি সত্য, দেবী কিরীটেশ্বরীকে বাংলার হিন্দু-মুসলমান একইসঙ্গে মিলেমিশে পুজো করে এসেছেন যুগ পরম্পরায়।