রাজপুরের শ্রীশ্রী বিপত্তারিণী চন্ডী মায়ের কিছু অজানা কথা

নিউজ ডেস্ক: ১৩২৩ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে কার্তিক পুজোর দিন ভোরে জন্ম নেন এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বাবা দুলাল (দুলাল চন্দ্র দাস)। বাবা দুলাল জন্মানোর কিছুক্ষন পরেই ঐ ভোরের বেলায় কয়েকজন অপরিচিত কীর্তনীয়া রাজপুর গ্রামের রাস্তা দিয়ে কীর্তন গেয়ে যেতে যেতেই তাঁরা হঠাৎ করে শ্রী সাধন চন্দ্র দাসের বাড়ির ভিতরে ঢুকে বাবা দুলাল যে ঘরে জন্মান সেই ঘরের বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কীর্তন গাইতে লাগলেন, ”যশোদা নন্দন, নন্দের দুলাল এলো রে, রাজপুর ধামেতে বাবা দুলাল এলো রে।”

আরও পড়ুন-‘একদিন দেশের জাতীয় পতাকার রঙ গেরুয়া হবে’, হিজাব বিতর্ক উস্কে দিলেন বিজেপি মন্ত্রী

১৩২৮ বঙ্গাব্দে মাঘ মাসের কৃষ্ণপক্ষের শনিবার রক্ষাকালী রূপে জগন্মাতার দর্শন পায় বাবা দুলাল। পরের সোমবার জগন্মাতারূপি দক্ষিণা কালিকামূর্তি বাড়িতে এনে বালকের লীলাখেলা আরম্ভ। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে ১০ বছর বয়সে ‘বিপত্তারিণী চন্ডী’র দর্শন এবং মাতৃমুখে ‘বাবা দুলাল’ ডাক শ্রবণ। ঐ ডাক শুনে দুলালের সর্বাঙ্গ আনন্দে অবশ হয়ে গেল। সামনে দেখল অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে। পরণে লাল বেনারসী শাড়ি, নাকে আবার নথও আছে, কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো একটি ছোট্ট সিংহ। ঐ সিংহের পিঠে তিনি বসলেন আর বললেন — “দেখ বাবা দুলাল, আমার যে কালী মূর্তি গড়তে দিয়েছ, সে মূর্তি হবে না। কি মূর্তি হবে দেখে নাও। সিংহবাহিনী চতুর্ভুজা কালী মূর্তি।” আরো বললেন — “আমার হাতে নরমুন্ড থাকবে না, গলাতেও থাকবে না মুন্ডমালা। নিচের বাঁ হাতে ধরলেন মহাশূল, ওপরের বাঁ হাতে খড়গ, নিচের ডান হাত বরদায়িনী, ওপরের ডান হাত অভয়দায়িনী। এই রূপই আমি ধরবো। আর বিপত্তারিণী চন্ডী নামে প্রচার লাভ করবো।”

আরও পড়ুন-চলতি বছরে জিডিপি কি হতে পারে জানালেন শক্তিকান্ত দাস

মাতৃ নির্দেশে বিপত্তারিণী চন্ডী মূর্তি গঠন এবং নিজের মাথায় করে গৃহে এনে স্থাপন করল বাবা দুলাল। একদিন পাঠশালায় পড়ার শেষে ঠাকুরদার থেকে পাওয়া টাকা নিয়ে পটুয়াপাড়ায় গিয়ে মা চন্ডীর ছোট মূর্তি তৈরির বায়না করলেন। মূর্তি তৈরি হলে দুলাল নিজে মাতৃমূর্তি চন্ডী মায়ের মূর্তি মাথায় নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে পটুয়া তাঁকে বাধা দেয়, ছোট ছেলে মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ি যেতে পারবে না। সবাইকে অবাক করে দুলাল মাথায় মা চন্ডীর মাতৃমূর্তি উঠিয়ে নিলেন অনায়াসে। এদিকে বাড়িতে পাঠশালা থেকে ছেলে কোথায় গেলো সেই নিয়ে সবাই চিন্তিত। দুলাল একটা মৃন্ময়ী চন্ডী মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ির দিকে আসছে। এই দৃশ্য দেখেই তিনি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তাঁর বাবা। তিনি দুলালকে বললেন, ”তুমি এই চন্ডী মূর্তি নিয়ে ঘরে ঢুকবে না। ঐ মূর্তি সদর দরজার বাহিরে রাস্তায় রেখে ঘরে ঢুকবে কারন আমরা নিম্ন বর্নের মানুষ, তাই আমাদের ঐ মূর্তি ঘরে ঢোকানোর অধিকার নেই। তুমি ঐ মূর্তি দরজার বাহিরে রেখে ঘরে ঢুকবে।” এই কথা তিনি বললেও দুলাল কোন উত্তর না দিয়ে মাতৃমূর্তি মাথায় নিয়ে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। দুলাল জননী তখন দুলালের এই রকম অবাধ্যতা দেখে খুব রেগে গিয়ে বাড়ির উঠোনে একটু ঝোপঝাড়ে রাখা একটা বেতের ডাল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুলালকে মারতে শুরু করলেন কিন্তু দুলাল নির্বিকার। তখন দুলালকে ঠাকুরদা রক্ষা করলেন এই মার খাওয়ার হাত থেকে। রাতে দুলাল এর মা স্বপ্নে দেখলেন, যেন একটা শ্যামবর্না অপরুপা সুন্দরী কিশোরী কন্যা লাল বেনারসি শাড়ি পরে যেন, আড়াল থেকেই তাঁকে বলছে, ”তুই আমার পিঠের দিকে তাকিয়ে দেখ, আমার পিঠে কিরকম কালশিটে দাগ পড়েছে। তুই দুলালকে মারলি, বেত দিয়ে। ঐটুকু বাচ্চা ছেলে কি ঐরকম মার সহ্য করতে পারে ?সেইজন্যই দুলালের পিঠের উপরে আমার পিঠ দিয়ে ওকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছি বলে, আমার পিঠে কালশিটে দাগ পড়েছে।” এইকথা বলে সেই শ্যামবর্ণা অপরুপা সুন্দরী কিশোরী কন্যা অদৃশ্য হয়ে গেলেন স্বপ্নে। তখনই দুলাল জননীর ঘুম ভেঙে গেলে তিনি বুঝতে পারলেন, এই শ্যাম বর্ণা কিশোরী কন্যা স্বয়ং মা চন্ডী। তিনি ছাড়া অন্য কেউ নন। দুলাল জননী তারপর চন্ডী প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করলেন‌। সেই থেকেই আজও মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি দুলালের বাড়িতে পূজিতা হয়ে আসছেন, দুলালের অবর্তমানেও। এইভাবে মা চন্ডী বাবা দুলালের গৃহে মৃন্ময়ী মাতৃমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলেন।

আরও পড়ুন-কোন কোন জেলায় হতে পারে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা

পরের দিন প্রত্যুষে আদি গঙ্গায় অবগাহনের পরে সিঁড়ির উপর এক মনোরম শীলাখন্ড পেয়ে বাবা দুলাল সেটি বাড়িতে আনে। রাতে তন্দ্রাভিভূত অবস্থায় সে দেখল এক নধর তনু, গৌরকান্তি, ব্যাঘ্রচর্ম আচ্ছাদিত পুরুষ হাতে ত্রিশূল ধারন করে হাসিমুখে অভয় হস্ত প্রসারিত করে তাকে বলছেন — ‘দেখ, চন্ডী তোমার কাছে এসে বাঁধা পড়লেন, সেজন্য আমাকেও আসতে হল। আমি তো চন্ডী ছাড়া থাকি না, আর চন্ডীও আমা ছাড়া থাকে না।’

১৩৩৪ বঙ্গাব্দে মাতৃ নির্দেশে বিপত্তারিণী চন্ডী ব্রত উৎসব আরম্ভ। ১৪ বছর বয়সে বাবা দুলালের শ্মশানে সাধনা শুরু। রাজপুর শ্মশানে শিব চতুর্দশী উপলক্ষে ৮ দিন ব্যাপী শ্মশানকে জাগিয়ে রাখার জন্য মেলা ও শ্মশান বাসের পরিকল্পনা করে বাবা দুলাল।

আরও পড়ুন-হাসপাতালে ভর্তি হলেন অভিনেতা আমোল পালেকর

১৩৪০ বঙ্গাব্দে মাতৃ নির্দেশে রত্নবেদী রচনা এবং পূর্ণ মাতৃরূপ দর্শন। বাবা দুলাল পঞ্চমুণ্ডীর আসনে বসে সাধনা করার দৈবাদেশ পান। কিন্তু তাঁর গর্ভধারিণী বিরূপ মত প্রকাশ করে বলেন — “পঞ্চমুণ্ডীর আসন কেবল সিদ্ধ ও যোগ্য সাধক এবং তপস্বীদের জন্যই প্রযোজ্য। সাধারণ মানুষের তাতে অধিকার কোথায় ? তুমি এমন আসন তৈরি কর যাতে সর্বসাধারণ অক্লেশে স্পর্শ করতে ও বসে সাধনা করতে পারে।” আপন জন্মদাত্রী মায়ের এই আদেশকে স্বয়ং বিশ্বধাত্রী মায়ের আদেশ জ্ঞান করে বাবা দুলাল পঞ্চমুণ্ডের বদলে সিদ্ধাসন রচনা করলেন পঞ্চরত্ন দ্বারা এবং বিধিবৎ তাতেই বসে সাধন আরম্ভ করলেন। তাঁর গর্ভধারিণী পুত্রের এই আচরণে যারপরনাই প্রীত হয়ে সাধনায় শীঘ্র সিদ্ধিলাভ করার আশীর্বাদ করেছিলেন। হয়েছিলও তাই, মাত্র ২৪ প্রহর গত হতেই পরমেশ্বরী সন্তুষ্ট হয়ে বাবা দুলালকে সিদ্ধমন্ত্র ও দর্শনদানে কৃতার্থ করেছিলেন।

আরও পড়ুন-তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে কংগ্রেসের হয়ে মনোনয়ন জমা দিলেন কোন্নগরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাপ্পাদিত্য চট্টোপাধ্যায়

শ্রীশ্রীচন্ডী মাতা প্রতিদিন অষ্টম বর্ষীয়া কন্যা রূপে বাবা দুলালের কাছে আসতেন ও বলতেন — “আমি আদ্যাশক্তি, বিপত্তারিণীরূপে আবির্ভূত হয়ে তোমার পূজা গ্রহণ করব। আমার এই রূপ অন্য কোথাও প্রচলিত নেই, তাই এই রূপের পূজাপদ্ধতিও নেই। শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস ভরে যে আমাকে যে বিধিদ্বারা সেবা নিবেদন করবে, আমি তারই হয়ে যাব। তুমি এখানে জাতিভেদ ও ধর্মভেদ না রেখে সকলকে আসার অনুমতি ও সুযোগ দেবে। সকলেই আমার সন্তান, সকলেই যেন আমার চরণপরশের অধিকারী হয়। অতিঘনঘোর বিপদের সম্মুখীন হয়ে ‘জয় বিপত্তারিণী চন্ডিকে’ উচ্চারণ করে যে নিরন্তর আমাকে স্মরণ করে যাবে, আমার শরণাপন্ন হবে, আমি অবশ্যই তাকে আপদমুক্ত করব।”

১৩৮৩ বঙ্গাব্দে(১৯৭৬ খ্রি.) রাজপুরে চন্ডীবাড়ির নতুন মন্দির স্থাপনা হয় এবং জ্যৈষ্ঠ মাসের ফলহারিণী ব্রতের দিন ‘মা’ নতুন মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৩৮৭ বঙ্গাব্দে(১৯৮০ খ্রি.) চন্ডীবাড়ি সংলগ্ন জমি ক্রয় করে ‘পঞ্চতীর্থ’ মন্দির নির্মাণ কাজ আরম্ভ হয়।

আরও পড়ুন-তালিকা প্রকাশের পর থেকেই চাপানুতর আলিপুরদুয়ারে, অবশেষে জেলা তৃণমূল হস্তক্ষেপে প্রার্থী বদল

মন্দিরে প্রতিদিন নিষ্ঠা সহকারে পুজো হয়। নিয়ম অনুসারে এখানে আষাঢ় মাসের রথ থেকে উল্টোরথের মাঝের মঙ্গলবার ও শনিবার-এ বিপত্তারিণীর পুজো হয়। পুজোর দিন একেবারে ভোর থেকেই এখানে ভক্ত সমাগম শুরু হয়ে যায়। সবাই মাকে তেরো রকমের ফল, মিষ্টান্ন দিয়ে পুজো দেন।

শিয়ালদহ সাউথ স্টেশন থেকে ট্রেন পথে সােনারপুরে নেমে রাজপুর আসা যায়। মন্দির প্রাঙ্গনের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও মায়ের অমোঘ আকর্ষণে অগণিত ভক্ত প্রত্যহ আসেন রাজপুর বিপত্তারিণী চন্ডীবাড়িতে। লোকজন বিশ্বাস করেন রাজপুর বিপত্তারিনী চন্ডী বাড়িতে মায়ের আরতির সময় মাকে আপনার সমস্যা জানান, মা ঠিক সমাধান করে দেবেন। এখানে মা চন্ডীকে ভগবান ভেবে নয়, নিজের মা ভেবে সব কিছু মনে মনে জানান, মা নায্য বিচার করে সমাধান করে দেবেন।

সংগ্রহীত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *